গ্রামে গঞ্জে বাড়ির ঠিকানার সন্ধান পেতে লাগে না নম্বর দেওয়া লেন বা বাই-লেন ।  সেক্টর, ব্লক এই সব হরেক রকম শহুরে আদব কায়দা এখনও রপ্ত করে উঠতে পারে নি গ্রামের বা মফঃস্বলের ঠিকানা । আমাদের হরিপালও এর ব্যতিক্রম নয় । আগে পোষ্টঅফিসের বড়বাবু থেকে পিওন প্রায় সকলেই নাম ধরে ধরে লোকজনকে  চিনত ।  কেয়ার করুক বা না করুক কেয়ার অফ (C/O) এর নামটা দেখেই চিঠি পৌঁছে যেত ঘরে ঘরে, সঠিক ঠিকানায়  । এখন অবশ্য হরিপালের লোকবসতি বেড়েছে । সেদিনের ছোকরা ছেলেরা নিজেরাই বাপ-কাকা-জ্যাঠা হয়েছে ।  বাইরে থেকেও লোক এসে বাসা বেঁধেছে ।  তবুও এখানে প্রতিবেশীদের নামেই চেনা যায়, কয়েদিদের মতো ‘বাড়ির নম্বর’ দিয়ে নয় ।


এতো গেল চিঠি-চাপাটি পৌঁছে দেওয়ার কাহিনী । এখন যদি আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব বা পরিচিত অপরিচিত কাউকে বাড়িতে আসতে বলি, তখন তারা কী করে ঠিকানা  খুঁজে পাবে? নিশ্চয়ই বলবেন, আরে এতো সহজ ব্যাপার — অমুক গলির ডানদিকে ২টো বাড়ি ছেড়ে, কিংবা তমুক মিষ্টির দোকান, অমুক  ওষুধের দোকান আর শেষে ঐ ‘স্বর্গের লাষ্ট ষ্টেশন’ এ গিয়ে “আমার নাম বললেই দেখিয়ে দেবে ” । এই মাইলষ্টোন দেওয়া ঠিকানা খোঁজার বিড়ম্বনার একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল ।  তখন আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে কলকাতায় বেহালার কাছে একটা ভাড়া বাড়িতে থাকতাম ।  কোনও একটা জরুরী কারণে আমার বাবাকে সেখানে যেতে হয়েছিল আমাকে একটা জিনিষ নিয়ে আমাকে দেওয়ার জন্য । জেমস্ লঙ সরণীর ওপর তিনতলা বাড়ি, চেনা খুব সহজ ছিল ।  গেটের পাশেই একটা ভাঙা টেম্পো, যার চাকাগুলো মাটিতে অনেকটা বসে গেছে, অনেকদিন ওখানে পড়ে থাকার জন্য ।  ওটাই ছিল পথনির্দেশক ।  যেদিন বাবার যাওয়ার কথা, একটু দেরি হচ্ছে দেখে বাইরে বেরিয়ে দেখি বাবা একটু দূরে পায়চারি করছে আর লোকজনকে কিছু জিজ্ঞেস করছে । আমার আশ্চর্য হওয়ার তখনও বাকি ছিল ।  নিজের চোখকে বিশ্বাস ই করতে পারছিলাম না ।  যে ভাঙা গাড়িটা এতদিন ধরে ওখানে পড়ে ছিল সেটা কোনও এক অজ্ঞাত কারনে রীতিমত বেপাত্তা , কেউ তুলে নিয়ে গেছে, সেইদিন সকালেই ।  বাবার মনের অবস্থাটা বুঝতে আমার অসুবিধে হয় নি, ঠিকানাটা খুঁজে না পাওয়ার বিরক্তি টা স্বাভাবিক – আর হ্যাঁ, মনে রাখতে হবে তখন হাতে হাতে মোবাইল  ছিল না ।  বাবা রসিকতা করে সামনে দাঁড়ানো একটা গরুকে দেখিয়ে বলেছিল — তার চেয়ে বলতে পারতিস একটা গরু দাঁড়িয়ে আছে যে বাড়িটার সামনে, সেটাই তোর ঠিকানা ।
যাই হোক, এত কিছু কথা বলা যে কারণে, সেটা হলো আমার হরিপালের বাড়ির  পথনির্দেশ বা ঠিকানায় একটা কথাই যথেষ্ট ছিল, আর তা হলো ‘হরিপাল গুরুদয়াল স্কুলের উল্টোদিকে’ । এই অ্যাটাচমেন্টটা থেকে যাবে সারাজীবন।  এই স্কুলের পাশেই হরিপাল হাসপাতালে আমার জন্ম ।  যদিও আমরা হরিপালে আসি এর প্রায় এক দশক পরে । ক্লাস ফাইভ থেকে টেন এই ছ’বছর স্কুলের অন্দরমহলে থাকার সুযোগ থাকলেও স্কুল আমার অন্তরে আছে চিরদিন ।  অজস্র স্মৃতি ঘোরাফেরা করে এই স্কুলকে ঘিরে ।

এই যে স্কুলের উল্টোদিকে বাড়ি বা বাড়ির  উল্টোদিকে স্কুল হওয়ার সুবিধে যেমন ছিল, অসুবিধেও কম ছিল না ।  স্কুলের খুঁটিনাটি ঘটনাগুলো বাড়ির “লাইন-অফ-সাইট” এ থাকার জন্য অনেক আনন্দই মাঠে মারা যেত ।  সেটা হঠাৎ কোনও কারণে স্কুল ছুটির পর মাঠে নেমে খেলাই হোক বা টিফিন টাইমে আইসক্রিম, গুড়বাদাম বা হজমিগুলি চেখে দেখাই হোক ।  একে তো দুই মামা এক মেসো শিক্ষক তার ওপর তথাকথিত “ভাল ছেলে” হওয়ায় সর্বদা স্পটলাইটের নীচে থাকা আমার জীবনের বেড়াজালগুলো বাধা হয়ে আমাকে স্বতস্ফূর্ত ভাবে ঐ ছোট ছোট আনন্দ গুলোকে নিজের মতো করে উপভোগ করতে দেয় নি, সেটা আজ বেশ বুঝতে পারি ।  ঐ হজমিওয়ালার পাশে দাঁড়িয়ে লোভনীয় হজমিগুলি “চোখে দেখা”র চেয়ে “চেখে দেখা”র যে অপরিসীম তৃপ্তি ছিল সেটা আজও অনুভব করি ।
আমার বাড়ির ঠিকানার মতোই হরিপাল গুরুদয়ালকে তার ঠিকানা করে নিয়েছিল সেই ছোটখাট চেহারার  হজমিওয়ালা ।  স্কুল শুরুর সময়ে বা টিফিনের ব্রেক-এ অনেক শিশুমনের ঠিকানা খুঁজে পেয়েছিল সে ।  সেইসব স্কুলের বাচ্ছাদের মান যত না ছিল, প্রাণ ছিল তার শতগুণ ।
বিহারের মধুবনী জেলার চাঁদপুরা গ্রামের একটা ঠিকানা অবশ্যই ছিল মহম্মদ রফিকের ।  কিন্তু সেই ঠিকানা নিজের অজান্তেই বদলে গিয়ে এক “বন্ধু”র ঠিকানা পেয়ে গেল হরিপাল স্কুলের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা — নতুন ঠিকানা,  “গুরুদয়াল স্কুলের গেট” । এই স্কুলের হৃৎস্পন্দনের সাথে প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছে রফিক-বন্ধু ।
বাইরে পড়াশোনা বা চাকরীর কারণে বহুদিন আমি ছিলাম ঘরছাড়া ।  হরিপালের সঙ্গে নিত্যদিনের যোগাযোগ ছিল না বেশ কয়েক দশক ।  বাড়ি ছিল, কিন্তু বাড়ির  প্রিয়জনেরা আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছিল । এরমধ্যেই হলো সেই ছন্দপতন ।  অনেকটা সেই “কোনও এক গাঁয়ের বধূ” র শেষটার মতো —

“ডাকিনী যোগিনী এল শতনাগিনী এল পিশাচেরা এল রে
শতপাকে বাঁধিয়া নাচে তা তা তা ধি য়া
নাচে তা তা তা ধি য়া নাচে রে
কুটিলের মন্ত্রে শোষণের যন্ত্রে গেল প্রাণ শত প্রাণ গেল রে”

কোভিড-এর ভয়াল রূপ দেখল বিশ্ব ।  কচি-কাঁচাদের  স্কুলের ঠিকানা বদলে গেল ।  সেলফিস জায়েন্ট এর ক্যাসেল এর মতো নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল আমাদের সকলের পরিচিত  গুরুদয়াল স্কুল ।  ছেলেমেয়েদের কলকলানি নেই, নেই মাষ্টারমশাই দের ধমকানির আওয়াজ । “বন্ধু”ও তার ঠিকানা বদলালো — মন চলো নিজ নিকেতনে ।

তবে এই সময়ে একটা সুযোগ এল আমার সামনে, আশীর্বাদ হয়ে ।  ওয়ার্ক-ফ্রম-হোম এর লাইফ ষ্টাইলে ক্রমশঃ অভ্যস্ত হলাম আর সাময়িক  ভাবে আমার হোম-এর ঠিকানা হলো হরিপাল এর বাড়ি ।  আবার নতুন করে ফিরে পেলাম ছেলেবেলাকে ।

সব টানেলের শেষে যেমন আশার আলো থাকে, তেমনি কোভিড-এর অন্ধকার দিনগুলোও ফিকে হয়ে এল ।  গুটগুটি পায়ে ছেলেমেয়েরা আসতে শুরু করলো স্কুলে ।  জীয়ন কাঠির ছোঁয়ায় যেন শীত কেটে গিয়ে বসন্ত এল সেলফিস জায়েন্টের বাগানে ।


একদিন মুখোমুখি দেখা পেলাম রফিক-বন্ধুর, তার নিজস্ব  ঠিকানায় – গুরুদয়ালের গেটে ।  আজ আর কোনও দ্বিধা নেই, নেই ভাল-ছেলে হয়ে থাকার দায়বদ্ধতা ।  সঙ্কোচ যে একেবারে ছিল না তা বলবো না ।  পাশে দাঁড়িয়ে যে বাচ্ছাগুলো গুলতানি করছিল তারা বলতেই পারত “হে বন্ধু, তুমি আমারও বন্ধু, বাপেরও বন্ধু” ।  স্কুলজীবনের না খাওয়ার দেনা শোধ করলাম অর্থমূল্য দিয়ে ।  নিজেকে অনেক হালকা লাগলো যেন ।  স্কুল আবার গমগম করছে কিচিরমিচির আওয়াজে ।
“বন্ধু”ও ফিরে পেয়েছে তার ঠিকানার সন্ধান।

সুশান্ত সিনহা
১৯৮২ – মাধ্যমিক